অনুবাদ | বিশ্ব যানজটের রাজধানীতে স্বাগতম – মাইকেল হোবস | এএসএম মোস্তাফিজুর রহমান


বাংলাদেশের ঢাকার ভয়াবহ জ্যাম থেকে আমি যা শিখেছি


মাইকেল হোবস
৩ জুলাই, ২০১৪

আমি ষ্টীলের তৈরি ছোট একটি খাঁচায় বসে আছি যেটি একটি মোটরসাইকেলের সঙ্গে সংযুক্ত, যা বাংলাদেশের ঢাকার যানজটের মধ্যে থেমে থেমে চলছে।  গত ১০ মিনিটে চালক চাকাটিকে ডানে বামে ঘুরিয়ে আমাদের সামনের একটি ডেলিভারি ট্রাক ও একটি রিকশার মাঝখানের জায়গাটুকু দিয়ে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ইঞ্চি ইঞ্চি করে চলায় আমরা সম্ভবত তিন ফিটের মত সামনে এগিয়েছি।

আরও সামনে, যানবাহনগুলো এতই ঠেসে আছে যে পথচারীরা রাস্তা অতিক্রম করার জন্য পিকআপ ট্রাক এবং খালি রিকশার উপর দিয়ে যাচ্ছে।  আমার বামে দুই সারি পর একটি অ্যাম্বুলেন্স অনর্থক নীল বাতি ঘোরাচ্ছে।  চালক রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে আর সামনে কোথায় গাড়ি নেই দেখছে।  অল্প সময় পরপর হর্ন বাঁজাতে তিনি খোলা দরজার কাছে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার রাস্তার চিত্র
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার রাস্তার চিত্র
এটাই সকাল সাতটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত রাস্তার চিত্র।  আপনি যদি বিত্তবান হন, তাহলে আপনি কোন কাঁচ আবৃত গাড়ির পেছনের সিটে বসে এই অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন।  আর যদি দরিদ্র হন, তাহলে রিকশায় ক্লান্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন।

আমি বসে আছি একটি সিএনজির পিছনে, এটি তিন চাকা বিশিষ্ট একটি মোটরসাইকেল যা গোল আকৃতির পিঠার একটি টুকরার মত দেখতে এবং পরিত্যক্ত ধাতবে ঢাকা। আমি এখানে একটি মানবাধিকার প্রকল্পে কাজ করছি যেটি অপরিহার্যভাবে পোশাক শিল্পকারখানার সাথে সম্পৃক্ত, কিন্তু যখনি আমি ঢাকার মানুষজনকে জিজ্ঞাসা করি যে তাদের মতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সত্যিকারে কিসের উপর কাজ করা উচিত, তখন তারা আমাকে যানজট সম্পর্কে বলে।

এটি হয়তো স্কুল তৈরি কিংবা ম্যালেরিয়া নিরাময়ের মত উত্তেজক নয়, কিন্তু যানজট দূর করা আমাদের সময়ের উন্নয়নের অন্যতম কঠিন চ্যালেঞ্জগুলোর একটি।  পৃথিবীর অর্ধেক জনসংখ্যা ইতোমধ্যে শহরে বাস করে এবং জাতিসংঘের ধারণা অনুযায়ী ২০৫০ সালের মধ্যে এই অনুপাত প্রায় ৭০ শতাংশের কাছাকাছি বৃদ্ধি পাবে।

জাতিসংঘ কর্তৃক চিহ্নিত ২৩টি ‘মেগাসিটি’-র মধ্যে শুধুমাত্র পাঁচটি উচ্চ আয়ের দেশে রয়েছে, যার সড়কগুলোর উপর সন্নিবেশ করানো গাড়ির ক্রমবর্ধমান লাইন মোকাবেলার জন্য অবকাঠামো বিন্যাস্ত করা (আপনি যা বাস্তব, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে আখ্যায়িত করেন) ।  মেক্সিকো শহরের রাস্তায় প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য দুটি গাড়ি যোগ করে যা তার মোট জনসংখ্যার অধিক। আর ভারতে, এর অনুপাত তিন থেকে এক।

ঢাকা, কিছু সমীক্ষায় বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ ও দ্রুততম বর্ধনশীল শহর এবং জনসংখ্যায় দিকে ২০তম, এটি একটি গবেষণার বিষয় যে কিভাবে এই সমস্যাটি এত খারাপ হয়েছে এবং কেন এটি সমাধান করা এত কঠিন।

অনেক উন্নয়নশীল দেশের রাজধানীর মতো ঢাকার অবকাঠামো তার জনসংখ্যার সাথে সামঞ্জস্যপর্ণ নয়।  এক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই শহরের মাত্র ৭ শতাংশ জুড়ে রাস্তা রয়েছে যেখানে প্যারিস ও ভিয়েনায় রয়েছে ২৫ শতাংশ এবং ওয়াশিংটন ও শিকাগোর ৪০ শতাংশ।  এছাড়াও, ঢাকার মহাসড়কের সাথে সংযোগ স্থাপনকারী শাখা সড়কগুলোতে পরিকল্পিত সড়ক বিন্যাসেরও অভাব রয়েছে।  এখানে ৬৫০ টি প্রধান সংযোগ সড়ক রয়েছে কিন্তু মাত্র ৬০ টি ট্রাফিক বাতি রয়েছে যার অনেকগুলোই কাজ করে না।  যার মানে হচ্ছে, পুলিশ বাহিনী গাড়ী চালনা বা পাকিং নিয়মাবলী প্রয়োগ করছে না; তারা সংযোগ সড়কে যানবাহনকে দিক নির্দেশনা দিচ্ছে।

ঢাকার যানজটের কারনে বছরে প্রায় ৩.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয় এবং তা শুধু মাত্র বিলম্ব ও বায়ু দূষণের জন্য, যা জীবন মানের স্বল্প-উপলব্ধ ক্ষয়ক্ষতির জন্য নয়।  আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধীপূর্ণ মনে হলেও সত্য যে, দুর্বল অবকাঠামোই নগরীর দ্রুততম বৃদ্ধির অন্যতম কারন।  উপশহরগুলো থেকে যাওয়া আসার রাস্তা বা ট্রেন না থাকায় ঢাকার অধিবাসীদের মাঝপথে জড়ো হওয়া, উঁচু ভবনগুলোর মাঝখানে বস্তি গড়ে তোলা এবং পায়ে হেঁটে কাজে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।

“ওটা দেখেছ ?” এবড়ে থেবড়ো তোশকের একটি ছাদের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে আমার এক বাংলাদেশী সহকর্মী জিজ্ঞাসা করল।  “যেখানে আমাদের দেশের শ্রমিকরা বসবাস করে।”

এবার রাস্তাঘাট ব্যবহারকারীদের কথায় আসা যাক।  সংকীর্ণ রাস্তাগুলো পথচারী ছাড়াও বাইসাইকেল, রিকশা, স্কুটার, মোটরসাইকেল, সিএনজি, বাস ও গাড়ি দ্বারা যৌথভাবে ব্যবহৃত হয়।  এসব যানবাহন ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় দখল করে নেয় এবং এদের সর্বোচ্চ গতিও ভিন্ন হয়। এটি টেট্রিস (Tetris – ভিডিও গেম) এর একটি সংস্করণের মত যেখানে কোন আকৃতিই উপযুক্ত নয়।

বাংলাদেশের মানুষের সাথে কথা বললে অধিকাংশই যানজটের জন্য রিকশাকে দোষারোপ করে।  তাদের অধিকাংশই বলে যে, এগুলো এতো ধীরে চলে যে এরা এদের পিছনের গাড়ি, বাস ও সিএনজিগুলোকে আটকে দেয়।  কিছু রাস্তা ‘শুধুমাত্র গাড়ীর জন্য’ চিহ্নিতকরণ, প্রশস্ত রাস্তা ও ওভারপাস নির্মাণ এবং দ্রুতগতির সামনে থেকে ধীরগতির যানবাহন উঠিয়ে নেয়ার জন্য সরকারকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। 

আর, এটি আমাদের তৃতীয় কারণের দিকে নিয়ে আসে যে যানচলাচল সমস্যা সমাধান করাটা এতটা কঠিন কেন: রাজনীতি।  এসব বিষয়ের সবই সহজ সুস্পষ্ট মনে হয়, কিন্তু এগুলোর জন্য মূল্য দিতে হয়।  ১৫ লাখ মানুষ জীবিকার জন্য রিকশা চালায়, অতিরিক্ত আরও লক্ষাধিক এগুলোর মালিক এবং তাদের মেরামাত করে।  মানুষকে রিকশা থেকে বেরিয়ে আসা এবং বাস ও ট্রেনমুখী করার সরকারি প্রচেষ্টা বিরাট বিরোধিতার সম্মুখীন হবে।

এমনকি বাসের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করানো আরও জটিল।  ২০০৯ সালে বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ঢাকায় ৬০ টি পৃথক বাস কোম্পানি আছে, যাদের প্রতিটির নিজের পরিবর্তিত রুট এবং সময়সূচী অনুযায়ী আছে। যাত্রীরা কতদূর ভ্রমণ করছে তা অনুযায়ী ভাড়া নেওয়া হয় এবং অতিরিক্ত ভাড়ার জন্য চালকের সাথে দর কষাকষি করতে হয়।  যেহেতু বাস কোম্পানিগুলো একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করে, তাই চালকেরাও বেপরোয়াভাবে চালাতে এবং ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি যাত্রী নিতে উৎসাহিত হয়।

অধিকন্তু, গনপরিবহন আদৌ জনসাধারণের নয়।  অনেক বাস কোম্পানি রাজনৈতিক দল বা ক্ষমতাধর ট্রেড ইউনিয়নের মালিকানাধীন বা সম্পর্কযুক্ত। এ ব্যবস্থাকে একীভূত বা নিয়মতান্ত্রিক করার সরকারি প্রচেষ্টায় সব ছোট কোম্পানিগুলো অধিগ্রহনের মুখে পড়বে।

সুস্পষ্ট সমাধান বা আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের দ্বারা একটি প্রস্তাব হচ্ছে রিকশাগুলোকে গাড়ি ও সিএনজি থেকে আলাদা করা, প্রত্যেককে তাদের সর্বোচ্চ গতি অনুযায়ী আলাদা পথ করে দেওয়া এবং জটিল হলেও গাড়িচালকদেরকে রাস্তাঘাটে অধিক জায়গা নেওয়ার জন্য বাড়তি টাকা পরিশোধে বাধ্য করা।

তবে রাজনৈতিকভাবে বললে এটা অবাস্তবিক যেখানে সবাই এক রাক্ষসে ঈগলের পিছনে কাজ করার জন্য ছুটছে। গাড়ির মালিকেরা মোট জনসংখায় ক্ষুদ্র একটা অংশ তবে তারা হচ্ছে অত্যন্ত প্রভাবশালী ও রাজনৈতিকভাবে প্রয়োজনীয় একটি অংশ। অবশ্যই একজন সরকারি কর্মকর্তা বা ব্যবসা নির্বাহীর একটি গাড়ী এবং একটি ড্রাইভার থাকা হচ্ছে আত্ম-জাহির করা।

সর্বোপরি, কিসের উন্নয়ন যদি আপনাকে এখনও একই রেখাচিত্তে ধোঁয়া, হর্ন ও তাপের মধ্যে রিকশা  চালাতে হচ্ছে ? প্রতি বছর ঢাকার ভিড়ে ঠাসা রাস্তাগুলোতে বাড়তি ৩৭০০০ গাড়ি যোগ হয়।  ঢাকার অনেক অধিবাসী বোধগম্যভাবে এটাকে একটি সাফল্য, উজ্জ্বল বাংলাদেশের চিহ্ন ও মধ্যম আয়ের ভবিষ্যত হিসাবে দেখে।

এমনকি পুলিশও সমস্যার সমাধান করা কঠিন করে তোলে। বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণে দেখা যায় যে মাত্র ৫০ শতাংশ বাস চালক এবং অর্ধেকেরও কম সিএনজি চালকের সঠিক লাইসেন্স আছে।  পুলিশ জাল, মেয়াদউত্তীর্ণ, অথবা অযৌক্তিক কাগজপত্র উপেক্ষা করার জন্য ঘুষ গ্রহণ করে।  লাইসেন্সিং ব্যবস্থা হালনাগাদ ও নিয়মিতকরণ এবং প্রথাগতভাবে ট্রাফিক আইন প্রয়োগ করা মানে একজন নিম্নস্তরের গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য আয় প্রবাহ কমানো।

এসব কিছু একজন বাংলাদেশি রাজনৈতিকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভাবুন।  যানচলাচল সমস্যা সমাধানের যে কোন প্রচেষ্টা হল দরিদ্র, মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং ধনীদেরকে একসাথে ক্ষেপানো।  এটি মূলত প্রেসিডেন্ট ওবামা বনাম স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা, যেখানে শুধু রোগী, ডাক্তার ও বীমা কোম্পানীর বদলে রিকশাচালক, পুলিশ এবং বাস সংস্থাগুলো।  কারন আমেরিকানরা এখন ভালভাবে জানে যে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক বিলুপ্ত হয় না তা আপনি লক্ষ্য করবেন কিভাবে সেগুলো অকার্যকর।  [.....]

তারিখঃ ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭

Post a Comment

Previous Post Next Post